অন্যমনে সাহিত্য. অন্য রকম দৃষ্টিকোন থেকে দেখা একটি প্রতিবিম্ব ভাবনা .. অন্যমনে সাহিত্য.

বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট, ২০২১

গল্পে সুদীপ ঘোষাল

 

শঙ্খধ্বনি
========================


- আরে ছ্যা ছ্যা, বিছানাটা নোংরা করে রেখেছো। রাতে ডাকতে পারতে মা।

- ডেকেছিলাম রে অনেকবার। তো এমন বেগ, বাগ মানল না রে, বিছানায় হয়ে গেল।

- খুব ভালো করেছ, এবার বাইরে এস।

মিনতির বয়স হয়েছে পঁচাশি বছর।গ্রামে অনেক বুড়ি আছে যারা নব্বই বছরেও লাঠি হাতে হাঁটে। কিন্তু মিনতির পা দুটো অসার। সরু হয়ে ঝুলছে। কোন কাজ করে না। ফলে হাঁটতে পারে না। বিছানায় খাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুই করতে হয়। মিনতি বলে, বেশি বকিস না বাবা, শেষ সীমানায় এসে গেয়েচি আর কয়েকটা দিন।

তপন,ঝপন মায়ের সেবা করে কিন্তু শীতকালে বিছানায় নোংরা দেখলে তাদের মাথা গরম হয়ে যায়। মা কে দু চারটে কথা শুনিয়ে দেয়। ঝপণ বড় ছেলে। তার কোমরে জোর কমেছে। বেশি কাজ করতে পারে না কিন্তু তপন মায়ের কাজ করে দেয়। সকালে ব্রাশ করে চা খেয়ে মায়ের ঘরে এসে পরিষ্কার করে ঘর। নাকে গন্ধটা লেগে থাকে। কাজে যাওয়ার সময় শুঁড়িখানায় তপন দুশো গ্রাম মদ খেয়ে নিলেই গন্ধটা উধাও হয়ে যায়। তপন ভাটিখানায় মায়ের গল্প বলে, আমার মা কত কষ্ট করে নিজে না খেয়ে আমাদের বড় করেছে, আর আমরা মায়ের জন্য কতটুকু করতে পারি বল তামাল। পাশে বসা নেশাসঙ্গি তামাল মাতাল হলেও তালে ঠিক থাকে। তপন এলে তার মদের ভাগটা বাড়ে। পয়সাটা তপনই দেয়। তামাল উত্তর দেয়, তা তো বটেই, যতই হোক মা। মায়ের জন্য আমাদের জেবনে আত্মত্যাগ করা উচিত বইকি। তামালের শিক্ষিত ভাই বাইরে চাকরি করে, তাই বাবা, মা কে দেখতে গিয়ে তামালের বিয়ে করা হয়ে ওঠে নি। তামাল বলে,বাঁ-, জেবনটা গোলকধাঁধা। কিস্যু নাই শুধু জমির ভোমোসের মত জল বেরিয়ে যায় চোরাফুটোয়। তপন বলে,ভুলুক রে ভুলুকের মত ফুটো। কখন যে সময় ফুড়ুৎ হবে,কেউ জানি না। আর সকলেই মদ খায় আর চুপ করে দুজনের কথা শুনে ঘাড় নাড়ে। উপরে টুলে বসে থাকে শুঁড়িখানার মালিক। সে কিন্তু মদ খায় না। মাছরাঙার মত মেছেল সেজন,মহাজন। তপন বলে,লিখে রেখ দামটা, কাজে যাই। মহাজন বলে,তামালেরটা নিয়ে পাঁচশ টাকা হলো।তপন বলে,মাইনে পেলেই তোমারটা আগে দোবো। এখন কাজে যাই কাকা।



রোজকার নিয়মে চাঁদ ওঠে। মিষ কালো আঁধারের বাঁশবনে আলো ফুটে ওঠে। আর শাঁখে ফুঁ দেওয়ার সময়ে তপন বাড়ি ঢোকে।হাত পা ধোয়। মাস্কটা খুলে সাবান জলে ভিজিয়ে রাখে। আবার একটা নতুন মাস্ক পরে মায়ের ঘরে যায়,তাহলে মদের গন্ধটা মা বুঝতে।পারবে না আর নিয়ম রক্ষাটাও হয়। ঘুরে ঢুকলেই মা মিনতি বলে, এলি তপন, বোস বোস তোর সঙে দুটি কতা কই।

মিনতি বলে, আমি ভালো সাঁতারু ছিলাম, বুঝলি তপন। বেশি সাঁতার কেটে কি পা দুখানা গেলো?

তপন বলে, না মা ওটা বয়স বাড়লে হয়। ওসব চিন্তা কোরো না তো।

মিনতি বলে, তখন আমার ছেওটে বয়েস। গাছে উঠে কুল,বেল পেড়ে খেতাম খুব। তারপর কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে হলো। আমুদপুরের বউ বলে সকলে ডাকত আমাকে। একবার ননদের বিয়েতে পুলিশ সেজে বরযাত্রীদের নাচ দেখিয়েছিলাম। তারপর থেকে পাড়ায় আমুদপুরের আমুদে বউ বলেই সকলে আমাকে ডাকত, আর ভালোবাসত আমার খোলামেলা ব্যবহারে। তারপর তোর বাবা, কাকা, দাদু মরে গেলো আগুপিছু কোনো নিয়ম না মেনে। যে বয়সে বড় তার মরণ হলো ছেলেদের মরণের পরে। এখন আমার মরণটা হলে হয়, তোদের রেখে যেতে পারলে বাঁচি। হা রে তোর দাদা ঝপণ কেমন আছে রে, তাকে তো আর দেখি না দশ বারোদিন। তুই তো আসিস শুধু আর বৌমা খেতে দেয়। তপন বলে,মা দাদার শরীরটা ভালো নাই। ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছেন। মিনতি বলে, কলিকাল বাবা, বড় ভয় হয়, মরার কোনো নিয়ম নাই রে। সত্যযুগে শুনেছি বয়স্করা আগে মরত, তারপর ছোটরা। কিন্তু এখন সবকিছু ওলটপালট হয়ে পাপ বেড়েছে।

তপন বলে,ওসব ভেবে লাভ নাই, যা হবার তা তো হবেই মা।

মিনতির ঘরে তপন আর বৌমা ছাড়া আর কেউ ঢোকে না। সকলে এড়িয়ে চলে। নাতি,নাতনি আর বাকি বৌমারা নিজেদের কাজ নিয়ে থাকে। তপন সারাদিন কাজে থাকে। মিনতি দুপুরের খাবার পায় কিন্তু নাতি নাতনির সাড়া পায় না। তপনের বউ ভাতের থালাটা দূর থেকে বিছানার পাশে রেখে বলে,ভাত দিলাম, খেয়ে নিন। মিনতি ভাত খান চেটেপুটে। থালায় হাত ধুয়ে এক ঢোক বোতলের জল খান। তপন দুটো বোতলে সকালে জল দিয়ে রাখে। মিনতির ওই জলে সারাদিন চলে যায়। মাঝে বসে, ছেঁচড়ে, বাথরুমে আসে কোনোরকমে। আর ঝপণ আসে না। সন্দেবেলায় তপন আসবে। আপন মনে বকবক করে মিনতি। দুপুরটা কে যেন টেনে লম্বা করে দিয়েছে। ঘুঘুর ডাকটা মিনতিকে জাগিয়ে রাখে। শুয়ে মিনতিও তালে তাল দেন, ঘুঘুর ঘু। দুপুরে নাতি নাতনিরা চুপ করে ঠাকুমাকে দেখে যায়।মিনতি বলে,যা পালা, মা দেখলে বকবে। নাতনি বলে,ঠাকুমা তুমি ভালো আছো, তোমার কাছে বসব?

সঙ্গে সঙ্গে ডাক আসে ওঘর থেকে,ছুঁবি না দুপুরে। চান করতে হবে। নোংরা বিছানা। নাতি নাতনিরা ছুটে পালায়। মিনতির আহত বাতাস অতীতকালে চলে যায়। মন মনে মিনতি বলে,

কিশোরীবেলায় একটা রঙীন বাক্স ছিলাে পড়ার ঘরে। তার ভিতরে দুটি রবীন্দ্রনাথ একটা জীবনানন্দ আর কয়েকটা বাল্যকালের খেলনা ছিল। মন খারাপ হলেই পুরী থেকে আনা, নকশা কাটা পেন ও হলুদ কাশীরাম দাস বের করতাম বাক্স থেকে ।তখনই প্রভাতী সূর্যের ভালবাসা দখল করত আমার মন। তারপর বন্যা এলো, মাটির বাড়ি ভেঙ্গে পড়ল। জীবনের তোয়াক্কা না করে আমি ভেসে যাওয়া বাক্স ধরার চেষ্টায় বিফল হলাম। ভেসে চলে গেলে আমার স্বপ্ন। বাবা আমার কান্না দেখে নতুন বাক্স কিনে দিলেন। তারপর বড় হলাম। চাকরি পেলাম। আরও নতুন বাক্স কিনলাম। কিন্তু হায় সেই প্রভাতি সূর্যের ভালোবাসা আর পেলাম না।

সন্দেবেলায় আবার তপন ফেরে বাসায় পাখিদের মত। তপনকে মিনতি গল্প শোনান, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কাটোয়া আসতাম সোহাগি শরতে, পুজোর বাজারে,চলে যেতাম নিচুবাজারে গঙ্গার ধারে। বাবা পরিবারের সকলের জন্য জামা কাপড় কেনাকাটি করে শেষে পরাণের পান্তুয়া খাওয়াতেন পেট ভরে। এক সুন্দর সুগন্ধে ভুরভুর করত মনপ্রাণ।বাড়ির সকলের জন্য পরাণের পান্তুয়া কিনতেন বাবা। দুরন্ত কার্তিক লড়াই এলেও আদরের পরাণদার ক্ষীরের পান্তুয়া খেতাম মনভরে। কি এক অপূর্ব মায়া মাখানো পরাণ- পান্তুয়া। মুখে দিলেই মিলিয়ে যায় অনবদ্য স্বাদে।

কলকাতায় কাজের জন্য আসা, বাসা ভাড়া করে থাকা । আর কাটোয়া আসা হয় না। তবু পরাণের পান্তুয়া,কাটোয়ার গঙ্গা, ভাষাসদন, ছোটলাইন পাড়, সুবোধ স্মৃতি মোড়,বিজ্ঞান পরিষদ,রবীন্দ্র পরিষদ মায়া ঘিরে রাখে হৃদয় ছুঁয়ে...

তপন অবাক হয়ে শোনে মায়ের কথা। দাদা মরে গেছে শুনলে মা মরে যাবে। তাই দাদার খোঁজ করলেই তপন এড়িয়ে যায়,মরার খবর দেয় না। তপনের মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করে। সে ভাবে, মাকে দাদা মরার কথাটা বলতেই হবে। যা হয় হবে। তবু মা কে মিথ্যেকথা বলতে আর ভালো লাগে না। আজ রাতে তামালকে সঙ্গে নিয়ে মদের দোকানে গিয়ে আকন্ঠ মদ গিলে মায়ের ঘরের কাছে এসে শুনলো কান্নার আওয়াজ। কারা কাঁদে? তামাল বলে,কি হলো গো? সবাই কাঁনছে কেনে? তপন ভাবে, আবার কি যে হোলো, মা বলে এটা কলিকাল, মরণের কোনো আগুপেছু নাই গো...



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন